গণমাধ্যম সংবাদ
বরাবরের মত রাজস্ব প্রাপ্তির উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা এবারও থাকছে; সঙ্গে যোগ হচ্ছে ব্যয় সংকোচন নীতি, যে কারণে এবার বাজেট ঘাটতি সামান্য কমে আসার আভাস মিলেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্যে।
কিছুটা কমলেও আয়-ব্যয়ের ঘাটতি এখনও বিপুল, যে হিসাব মেলানোর কাজ ঠিকই করতে হচ্ছে বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। তবে তাদের সামনে বরাবরের মত এবারও ঘাটতি পূরণে বিকল্প কম, সেই ঋণ নির্ভরতাই প্রধান সমাধান।
এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম সুদের বিদেশি ঋণের পরিবর্তে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বেশি সুদের ঋণের ওপরই ভরসা করতে হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলছেন, সেভাবেই বাজেট ঘাটতি মেটানোর হিসাব-নিকাশ করা হচ্ছে।আর বিশ্লেষকরা বলছেন, বছরের পর বছর ধরে এমনটি চলতে থাকায় তা দেশের অর্থনীতিতে চাপ তৈরি করছে। ব্যাংক থেকে সরকারের বেশি বেশি ঋণ নেওয়ায় তারল্য সংকট পরিস্থিতিও দেখা দিয়েছে সময়ে সময়ে। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে তা বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। বেসরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি বারবার চাপের মুখে পড়ার কথা বলে আসছেন তারা।
তবুও আয়-ব্যয়ের বিপুল ঘাটতির এমন চক্র মেনে নিয়েই বাজেট দিতে হচ্ছে সরকারকে। এমন প্রেক্ষাপটে ব্যাংক ঋণের বিকল্প হিসেবে বাজেটে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য আনতে সরকারের ব্যয়ের লক্ষ্য কমানো, রাজস্ব আয়ের ‘লিকেজ’ কমানো, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় ও ভর্তুকি কমানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
ঘাটতির চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট থেকেই রাজস্ব আহরণ এবং ব্যয় ব্যবস্থাপনায় সরকারের নীতিতে পরিবর্তন ও সংস্কার আনার তাগিদ দিয়েছেন তারা।এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, “বাজেটে ঘাটতি বেশি হলে সেটি অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়ায়। সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ঠিক রাখতে হলে অবধারিতভাবে কঠিন শর্তের বৈদেশিক ঋণ নিতে হবে। কেননা বাংলাদেশকে কেউই সহজ ঋণ দিতে চাচ্ছে না।
“কারণ বাংলাদেশের রিজার্ভ কম। প্রতিবছর এই ঘাটতি হওয়া মানেই হচ্ছে অর্থনীতির ওপর ঋণের বোঝা আরও বেড়ে যাওয়া। সেটা দেশি হোক আর বিদেশি হোক। সেই ঋণের বোঝা ও কিস্তি বাজেটের সিংহভাগ খেয়ে ফেলবে। সুতরাং বাজেটে ভারসাম্য হওয়ার খুব দরকার ছিল।”
এমন প্রেক্ষাপট মাথায় রেখেই আগামী ৬ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২০৫ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। চলতি বাজেটের ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা থেকে মাত্র ৪ দশমিক ৪৬ শতাংশ বাড়িয়ে আগামী বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ধরার খবর এসেছে।এ ব্যয়ের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সম্পদ থেকে ৫ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার জোগান দেওয়ার চেষ্টার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের হিসাব নিকাশ করা হচ্ছে, যা চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার (৫ লাখ কোটি টাকা) চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। এ হিসাবে মোট বাজেট ব্যয়ের ৬৮ শতাংশ অভ্যন্তরীণ খাত থেকে জোগান দেওয়া গেলেও ঘাটতির বাকি ৩২ শতাংশের যোগান দিতে নেওয়া হবে দেশি-বিদেশি ঋণ।
বাজেট প্রণয়নের আগে কাটাছেঁড়ার মধ্যে এখন পর্যন্ত খবর অনুযায়ী, বাজেটে ঘাটতি ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৫৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা; যা জিডিপির ৫ শতাংশেরও কিছুটা কম। চলতি অর্থবছরে ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ৮৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ। ফলে এবারের বাজেটে আগের বছরের তুলনায় ঘাটতির পরিমাণ কমে যাচ্ছে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বা ১ দশমিক ১৬ শতাংশ।
জানুয়ারির সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, এখন বাংলাদেশের জিডিপি আকার ৫০ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা, যা অর্থবছর শেষে আরও কিছুটা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।
ঘাটতি পূরণে চলতি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বিদেশি ঋণ ও অনুদান থেকে এক লাখ ২৭ হাজার ১৯০ কোটি টাকা পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হলেও আগামী বাজেটে তা আরও বাড়িয়ে এক লাখ ৩১ হাজার ৩০০ কোটি টাকা করা হচ্ছে। এখানে অনুদান বাবদ ধরা হচ্ছে ৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেট হিসাব করা হয়েছিল তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকা।সেই হিসাবে আগামী বাজেটে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়তে যাচ্ছে ৩ দশমিক ২৩ শতাংশ।
তবে আগামী অর্থবছরে বিদেশি ঋণের সুদ ও কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে সরকারের খরচ দ্বিগুণ বেড়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বাজেট সংশ্লিষ্টরা।
চলতি অর্থবছরে বিদেশি ঋণ পরিশোধ বাবদ ২৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ধরা হলেও আগামী বাজেটে তা ধরা হচ্ছে ৩৬ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ফলে এ খাতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে প্রায় ৪৮ শতাংশ।
এ পরিমাণ ঋণ পরিশোধের পর আসন্ন বাজেটে বিদেশি নিট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৯৪ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা চলতি বাজেটের নিট ঋণ এক লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকার চেয়েও সাড়ে ৭ শতাংশ কম।
ঘাটতি পূরণে এবার সরকার ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যও আগের চেয়ে একটু বাড়িয়ে ধরছে।চলতি অর্থবছরে এক লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ধরা হলেও নতুন অর্থবছরে ধরা হচ্ছে এক লাখ ৬০ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদেশি ঋণের হার কমলেও দেশি উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা আগের চেয়ে ৯ শতাংশ বাড়তে পারে বলে আভাস মিলছে।
ব্যয়ের ঘাটতি মেটাতে গিয়ে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে নেওয়া এসব ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে আবার বড় অংকের টাকা খরচ করতে হচ্ছে সরকারের।
আগামী বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ এক লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকার মতো বরাদ্দ রাখার খবর এসেছে। এর মধ্যে দেশি ঋণের সুদ এক লাখ ৮ হাজার কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণের সুদ ২০ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে।
চলতি অর্থবছরে সুদ বাবদ ৯৪ হাজার ৪০১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল।
কী বলছেন বিশ্লেষকরা
দুটি কারণে বাজেটের আয়-ব্যয়ে ভারসাম্য আসছে না বলে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে সরকারের রাজস্ব আদায়ের প্রধান সংস্থা এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ বলেন, “ব্যয়ের বাজেট বাড়ানো হচ্ছে। সেখানে সুশাসন বা কৃচ্ছতাসাধন বা ব্যয় সাশ্রয়ী চর্চা হচ্ছে না। তার বিপরীতে উচ্চাভিলাষী বাজেট দেওয়া হচ্ছে এবং খরচ বাড়িয়েই যাচ্ছি। অবিলম্বে অনুশাসনহীন ব্যয় বন্ধ করতে হবে।
”সরকারি বিভিন্ন কেনাকাটার ক্ষেত্রে যেন খরচ বাড়িয়ে কেনা না হয়, যে বছরের প্রকল্প সে বছরেই শেষ করতে হবে। প্রকল্পের সময় বাড়িয়ে খরচ বাড়ানো যাবে না।”
অর্থনীতির বিশ্লেষক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাড়িয়ে সরকার গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে বরাদ্দ দিতে পারছে না। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে বিদ্যমান ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন।
“সরকার প্রশাসনে কিছু সংস্কার করুক, যেটার মাধ্যমে ব্যয় কমানো সম্ভব। এতগুলো মন্ত্রণালয় রাখার কোনো দরকার নেই। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের মত দপ্তর রেখে রেখে বড় ধরনের ব্যয় করা হচ্ছে। এগুলো আস্তে আস্তে উঠিয়ে দেওয়া দরকার। একটি মন্ত্রণালয়ের সাথে যে বিশাল বাহিনী, গাড়ির বহর- এগুলোর দরকার নেই।”
ব্যয় ব্যবস্থাতে পরিবর্তন আনার তাগিদ দিয়ে অর্থনীতির শিক্ষক ও গবেষক সায়মা হক বিদিশা বলছেন, চ্যালেঞ্জে থাকা অর্থনীতির চাপ কমাতে খরচের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে, যা সরকার করতে পারছে না।
“টাকা খরচ করাটাই মূল নয়। সঠিকভাবে বরাদ্দ হচ্ছে কিনা দেখতে হবে। আমাদের যেহেতু আয় কম, তাই খুব বেশি ব্যয় করার উপায় নেই। কোন খাত বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেখানে খরচ আগে করতে হবে। অপচয় না করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষ সুফল পাবে, সেই জায়গাটিতে ব্যয় করতে হবে।”