গণমাধ্যম নিউজ
১৬ই জুন, নারায়ণগঞ্জবাসীর কাছে অত্যন্ত শোকসন্তপ্ত দিন। ২০০১ সালের এ দিনে আওয়ামী লীগের অফিসে বোমা হামলায় নারীসহ ২০ জন প্রাণ হারিয়েছিলেন। লোমহর্ষক এ ট্রেজেডি সারা দেশে সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু ২৩ বছর পেরিয়ে গেলেও এ ট্রেজেডির বিচারকার্য শেষ হয়নি। হামলার সাথে জড়িতরা আইনের আওতায় না আসায় এখনও ডুকরে কাদছেন স্বজনহারা পরিবার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০১ সালের ১৬ জুন নগরীর চাষাঢ়া বিজয় স্তম্ভের পাশে আওয়ামীলীগ অফিসে শক্তিশালী বোমা হামলায় ৪ নারীসহ ২০ জন প্রাণ হারান। আহত হন সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। সেই সাথে অনেকেই চিরতরে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। বোমা হামলায় নিহত ব্যক্তিরা হলেন সাইদুল হাসান, আক্তার হোসেন, মোশারফ হোসেন, নজরুল ইসলাম, দেলোয়ার হোসেন ভাষানী, সাইদুর রহমান মোল্লা, নজরুল ইসলাম, স্বপন চন্দ্র দাস, শওকত হোসেন, স্বপন দাস, এনায়েত উল্লাহ, পলি বেগম, হালিমা বেগম, আবদুল আলীম, শুক্কুর আলী, নিধুরাম বিশ্বাস, রাজিয়া বেগম, আবদুস সাত্তার, আবু হানিফ নবী ও অজ্ঞাত নারী। বোমা হামলার ঘটনার পরদিনই শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এড. খোকন সাহা বাদী হয়ে বিএনপি নেতাকর্মীদের আসামী করে হত্যা এবং বিস্ফোরক আইনে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেন।
চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা চুড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করেন। অন্যদিকে বোমা হামলায় নিহত ফুটপাতের পিঠা বিক্রেতা হালিমা বেগমের ছেলে কালাম বাদী হয়ে শামীম ওসমান ও তার দুই ভাইসহ অনেককে আসামী করে মামলা দায়ের করেন। পরে প্রথম মামলার বাদী এডভোকেট খোকন সাহার আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের নিদের্শে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। এ মামলায় গ্রেফতার হয়েছিল চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টু, ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কমিশনার আরিফুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ জেলা যুবদল নেতা শাহাদাতউল্লাহ জুয়েল, হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নানসহ ১০ জন।
দীর্ঘ তদন্ত শেষে ২০০৩ সালে বিস্ফোরক মামলায় ও ২০১৪ সালে হত্যা মামরায় তদন্তকারী সংস্থা ৫ জনকে আসামী করে আদালতে অভিযোগ পত্র দখিল করেন। কারাগারে রয়েছে আদালতে একমাত্র স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেওয়া শাহাদাতউল্লাহ জুয়েল। পলাতক রয়েছে সহোদর আনিসুল মোরছালিন ও মাহাবুবুল মুত্তাকিম। জামিনে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাসেম শকু।
দীর্ঘ ২৩ বছরে হত্যাকান্ডের বিচারকার্য শেষ না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা। নিহত নজরুল ইসলাম বাচ্চুর স্ত্রী হামিদা বেগম কান্নারত অবস্থায় লাইভ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, আল্লাহ ধনী-গরীব কাউকে চিনতো না, আল্লাহ কাউরে ছাড় দিব না। আমি আল্লাহর কাছে বিচার চাই, তিনিই বিচার করবেন। আমার মাইয়ারা ছাড়া আমার আর কেউ নাই। থেরাপি আর ওষুধেই আমার দিন চলে, কথা কইতেও কষ্ট হয়। এইযে বাঁইচা আছি, এটা আধামরা জীবন। এমন জীবনের চেয়ে মইরা যাওয়া ভালো। কোন সহযোগিতা পাই না আমি। এমনেই যাইতেছে জীবন।
ঘটনার সময় গুরুতর আহত হওয়া রতন দাস বলেন, বোমা হামলার ২৩ বছর পেরুলো, ২৪ এ পড়েছে। বাংলাদেশের নানা হত্যাকান্ডের বিচার হলো, অথচ ১৬ই জুনের বোমাহামলার বিচার হচ্ছে না। বর্তমান সরকার ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছেন। বর্তমান সরকারের কাছে আমার দাবি, যারা বোমাহামলার সাথে জড়িত তাদের দ্রুত উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করুন।
বোমাহামলায় আহত হয়ে দুই পা হারিয়েছিলেন চন্দন শীল। বর্তমানে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। দ্রুত বিচার কার্য সম্পাদনের দাবি জানিয়ে তিনি লাইভ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, দোষীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। আমি জানি না কি কারণে আমাদের উপর হামলা হয়েছিল, আমার অপরাধটা কি। কিন্তু হামলা হয়েছে, অনেকে মারা গেলাম চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেলাম। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের উপার্জনের ক্ষমতা নেই। এদের দায়িত্বটা রাষ্ট্র গ্রহণ করুক, তাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হোক সেই দাবি করছি।
এদিকে, আদালতে সাক্ষী আসছে না বলে মামলার বিচারকার্য থমকে আছে বলে জানিয়েছেন জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারী কৌঁসুলি মনিরুজ্জামান বুলবুল। তিনি লাইভ নারায়ণগঞ্জকে বলেন, বিচার কার্যের জন্য সাক্ষীদের সাক্ষ্য গ্রহণ প্রয়োজন। কিন্তু কোন সাক্ষী আসছে না।
অতিরিক্ত সরকারী কৌঁসুলি আব্দুর রহিম বলেন, এ পর্যন্ত ৩২ জন সাক্ষ্য প্রদান করেছেন। কিন্তু সমন জারির পর অন্য সাক্ষীরা আসছেন না। এ ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। সাক্ষীদের খুঁজে বের করতে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা কাজ করছেন। আশা করছি, শীঘ্রই এ মামলার বিচারকার্যের সমাপ্তি হবে।
এব্যাপারে মামলার বাদী ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এড. খোকন সাহা বলেন, বোমা হামলায় ২০ জন শিক্ষিত মানুষ মারা গিয়েছেন। শামীম ওসমান, চন্দন শীলসহ অনেকেই আহত হয়েছেন। এ মামলা বিচার হবেই। ২০০১ সালের বোমা হামলায় এই পর্যন্ত যতজন সাক্ষী সাক্ষ্য দিয়েছেন এর দ্বারা মামলার বিচার কার্যের জন্য প্রয়োজনীয় ম্যাটারিয়াল পাওয়া গিয়েছে। মামলার শুরুতে অনেক অবিচার হয়েছিল। ২০০৩ সালে যখন ফাইনাল চার্জশিট রিপোর্ট দেওয়া হয় তখন আমাদের জানানো হয় নাই। অথচ নিয়ম হলো চার্জশিট দেওয়ার আগে এজহারকারী বা সেই পক্ষের লোকদের জানানো, যা আমাদের বেলায় করা হয় নাই। অনির্ধারিত তারিখে সব ফাইনাল করা হয়। কিন্তু আইন নিজের গতিতেই চলে। পরে আবার সেই মামলার তদন্ত শুরু হয়। মামলার আয়ু আমিনুল ইসলাম অনেক কাগজপত্র দেখাতে পারেন নাই। লাশের পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট; চন্দনশীল, রতন, কামাল সাহেব, শামীম ওসমানসহ অনেকের ইনজুরি সার্টিফিকেট নাই। মে মাসের ১৫ তারিখ তাকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, আমিনুল ইসলামের উত্তরে আদালত সন্তুষ্ট হয় নাই। আগামী ৫ কার্যদিবসের মধ্যে ম্যাজিস্ট্রেটের স্বাক্ষরসহ মামলার সাথে জড়িত গুরুত্বপূর্ণ কাগজ দেখানোর কথা বলা হয়। কিন্তু ১ মাস হয়ে যাচ্ছে সে কোর্টে আসে নাই।
তিনি বলেন, আমি আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদালতে আবেদন করবো। সে দোষী প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমিনুল ইসলামকে জরুরি কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাখা প্রদানের নির্দেশ দিতে বলা হয়েছে। অচিরেই এ বিচারকার্য শেষ হবে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার শান্তনা পাবেন। মামলা শেষ প্রান্তে, অনেক এভিডেন্সে এসেছে। তাই বিচারকার্য বিলম্বিত হওয়ার কোন কারণ নেই। এ জুন মাসে হয়ত নয়, তবে আগামী জুন মাস অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুন মাসের আগেই বিচার কার্য শেষ হবে। আমাদের অপেক্ষার পালাও শেষ হবে। এদেশে বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ন্যায় বিচার হচ্ছে।