গণমাধ্যম নিউজ
সিলেটে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে এখনও সাত উপজেলায় ৫ লাখ ৩৩ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেন, “বন্যা পরিস্থিতি আপাতত কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তবে আমরা সার্বিক পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছি। বন্যা কবলিতদের উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা হচ্ছে এবং বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ চলছে।”
পানি উন্নয়ন বোর্ড-পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, শুক্রবার সিলেটের গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে জকিগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপৎসীমার দুই মিটার ও কানাইঘাটে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ১ মিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
ভারি বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল না নামলে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হবে না জানিয়ে পাউবোর প্রকৌশলী বলেন, কিছুদিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। গত ২৪ ঘণ্টায় চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৯৩ মিলিমিটার। আর এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে ৬৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছিল।
এদিকে, বন্যার্তদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য ১৩১টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত করা হয়েছে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন সিলেটের ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. জন্মেজয় দত্ত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সিলেটের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ খয়ের উদ্দিন মোল্লা বলেন, বন্যায় কবলিত উপজেলাগুলোর কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা পেতে একটু সময় লাগবে। পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে জানানো যাবে।জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, অতিবৃষ্টি ও ঢলের কারণে জেলার গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জে মোট ৫ হাজার ৬০১ হেক্টর আউশ ধান, আউশ বীজতলা ও সবজি খেত কম বেশি প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে আউশ ধানের জমি রয়েছে ১ হাজার ৬৮২ হেক্টর। এ ছাড়া ৯২৭ হেক্টর আউশ বীজতলা ও ২ হাজার ৯৯২ হেক্টর সবজি খেত রয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া কার্যালয়ের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মোহাম্মদ সজিব হোসেন বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় সিলেটে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৬১ মিলিমিটার।বন্যায় সিলেট জেলার রাস্তাঘাটের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে জানতে চাইলে এলজিইডি সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী কে এম ফারুক হোসাইন বলেন, ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে উপজেলা প্রকৌশলীদের বলা হয়েছে। তবে বন্যার পানি সড়ক থেকে পুরোপুরি না নামলে এটা পরিমাপ করা যাবে। পুরো তথ্য পেতে আরও কয়েকদিন সময় লাগবে বলে জানান তিনি।
শুক্রবার দুপুরে গোয়াইনঘাট উপজেলা সদরের বাসিন্দা ও বাজারের ব্যবসায়ী সোহাগ চক্রবর্তী জানান, বন্যার পানি আগের থেকে কমেছে। তবে উপজেলার রাস্তাঘাটে এখনও পানি রয়েছে। বাজারের পানি নেমেছে।
সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার বাসিন্দা ও স্থানীয় সংবাদকর্মী মো. রেজওয়ান করিম সাব্বির বলেন, বন্যার পানি নামার পর শুক্রবার দুপুরে নিজের বাসাবাড়ি পরিষ্কার করেছেন।
তিনি বলেন, উপজেলার বিরাইমারা হাওর, খারুবিল, শেওলারঢুপ, বাহনহাওর, ঢুলটি, ডিবিরহাওর, কেন্দ্রী, হারুবিলসহ নিম্নাঞ্চলে পানি রয়েছে। তবে আগের থেকে পানি কমেছে। রাস্তাঘাট এখনও পানিতে তলিয়ে আছে।
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, গোয়াইনঘাটে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। উপজেলার তিনটি নদীর পানি বিপৎসীমার নিচে নেমেছে। আকস্মিক বন্যায় উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও ব্রিজ-কালভার্ট পরিদর্শন করা হয়েছে। এলজিইডি উপজেলা প্রকৌশলীকে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট ও ব্রিজ মেরামত ও সংস্কার করে যানবাহন ও জনচলাচল উপযোগী করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
বৃহস্পতিবার রাত দেড়টার দিকে সিলেটের প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান স্বাক্ষরিত বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জেলার ১৩টি উপজেলায় বন্যা প্রস্তুতি হিসেবে খোলা হয়েছে ৫৪৭টি আশ্রয়কেন্দ্র। বৃহস্পতিবার রাত ১২টা পর্যন্ত বন্যাকবলিত ৭ উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ৪ হাজার ৮০২ জন মানুষ। সিলেটের সাত উপজেলায় পানিবন্দি হয়েছেন ৫ লাখ ৩৩ হাজার ২০২ জন মানুষ।
বন্যায় সবচেয়ে বেশি পানিবন্দি হয়েছেন গোয়াইনঘাট উপজেলায় ২ লাখ ৪৫ হাজার ৭৫০ জন। উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নই বন্যা কবলিত হয়েছে আর ৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ২ হাজার ৩৫৬ জন।কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নের মধ্যে তিনটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়েছেন ৯৩ হাজার মানুষ। উপজেলায় ৩৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ১৩৫ জন মানুষ।
কানাইঘাট উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে নয়টি প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছেন ৮০ হাজার ৬০০ মানুষ আর ৩১টি আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ১৪৬৬ জন।
জৈন্তাপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে ৬৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছেন। উপজেলায় আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ৪৮টি। যার মধ্যে ৬৭৫ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
জকিগঞ্জ উপজেলায় আটটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি হয়েছেন ৩৯ হাজার ৮৫২ জন এবং উপজেলার ৫৫টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছেন ৯৫ জন মানুষ।
বিয়ানীবাজার উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটি বন্যা আক্রান্ত হয়েছে। এখানে পানিবন্দি হয়েছেন ৫ হাজার ৫০০ মানুষ আর আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন ৬০ জন।
গোলাপগঞ্জ উপজেলার মাত্র একটি ইউনিয়নে বন্যাকবলিত হয়েছেন ৩ হাজার ৫০০ মানুষ। যার মধ্যে ১৫ জন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন।
এরই মধ্যে ব্যাপকভাবে বন্যাকবলিত গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও জকিগঞ্জ উপজেলার বন্যা কবলিতদের জন্য ১০০০ বস্তা শুকনো খাবার, ৭৫ টন চাল ও নগদ আড়াই লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।